নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত
নিরক্ষরেখার
উভয় ৩৫ ডিগ্রি থেকে ৬৫ ডিগ্রি অক্ষাংশের মধ্যবর্তী মধ্য-অক্ষাংশে
বা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে দুটি ভিন্নধর্মী বায়ুপুঞ্জের মিলনের ফলে যে ঘূর্নবাতের সৃষ্টি হয় তাকে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত বলা হয়। উপক্রান্তীয় অঞ্চলে মেরু অঞ্চল থেকে আগত শীতল ও শুষ্ক ভারী বায়ু পুঞ্জের সঙ্গে ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আগত উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুপুঞ্জের সংঘর্ষ হয়। উষ্ণ
ও শীতল বায়ুপুঞ্জের মিলনস্থলে বা সীমান্তে শীতল ও ভারী বায়ু উষ্ণ বায়ুর স্থান দখল করে
ফলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তাতে
হালকা জলীয় বাষ্পপূর্ন উষ্ণ বায়ু প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে উদ্ধে উঠে বৃষ্টি ঘটায় । এভাবে
নাতিশীতোষ্ণ ঘুর্নবাতের উদ্ভব হয়। এটি
তরঙ্গ ঘূর্নবাত নামেও পরিচিত।
নাতিশীতোষ্ণ
ঘূর্নবাতের সৃষ্টি
নাতিশীতোষ্ণ
ঘুর্নবাত সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো দুটি ভিন্ন ভৌত ধর্ম বিশিষ্ট বায়ুপুঞ্জের মিলন। এই
বায়ুপুঞ্জ গুলি উষ্ণতা, ঘনত্ব
ও প্রবাহ দিক অনুযায়ী ভিন্ন প্রকৃতির হয়। যেমন - উত্তর গোলার্ধে দক্ষিন-পশ্চিম
দিক থেকে আগত উষ্ণ আদ্র পশ্চিমা বায়ু এবং উত্তর দিক থেকে আগত শীতল ও শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে মিলিত হয়ে নাতিশীতোষ্ণ
ঘূর্নিবাতের উৎপত্তি ঘটায়।
নাতিশীতোষ্ণ
ঘুর্নবাতের বৈশিষ্ট্য
১.
মধ্য-অক্ষাংশীয় নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে এবং
দক্ষিন গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তন করে।
২.
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতের ব্যাস ১৬০০ কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। একটি নাতিশীতোষ্ণ
ঘূর্নবাত সম্পূর্ন ইউরোপকে ঢেকে দিতে পারে।
৩.
সমচাপ রেখা গুলি 'V' আকৃতির
হয়ে থাকে ।
৪. নাতিশীতোষ্ণ ঘুর্নবাতে শীতল বায়ুপুঞ্জ, উষ্ণ বায়ুপুঞ্জের
থেকে দ্রুত গতি সম্পূর্ন হয়।
৫. নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত ৫ থেকে ২৫ কিমি গতিবেগে ধাবিত হয়। গতিবেগ কম হওয়ায় নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতে ক্ষয়ক্ষতি হয় না বললেই চলে।
৬. এই ঘূর্নবাতের ফলে মৃদু বৃষ্টিপাত হয় যা ফসল ও মানুষের
স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।
৭. ঘূর্নবাতের শেষের দিকে বর্জ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
৮. নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতের সঙ্গে প্রতীপ ঘূর্নবাত জড়িত থাকে।
৯.
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত সাধারণত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ধাবিত হয়।
১০.
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, ইউরোপের মধ্য অক্ষাংশীয়
অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত বেশি দেখা যায়।
১১. নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতের সাথে অল্টোস্ট্রাটাস ও নিম্বোস্ট্রাটাস মেঘ যুক্ত থাকে।
১২. ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের মতো নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতে ঝড়ের চক্ষুর অবস্থান লক্ষ্য করা যায় না।
১৩. এই ঘূর্নবাতে শীতল ও উষ্ণ সীমান্তের সৃষ্টি হতে দেখা যায়।
নাতিশীতোষ্ণ
ঘূর্নবাত ও জলবায়ুর ওপর প্রভাব
নাতিশীতোষ্ণ
ঘূর্নবাতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম আবহাওয়ার উপস্থিতিস লক্ষ্য করা যায়। ঘূর্নবাত
আগমনের পূর্বে বায়ুচাপ কমতে থাকে এবং চন্দ্র ও সূর্যকে কেন্দ্র করে সিরাস মেঘের বৃত্তাকার
দিব্যজ্যোতি অবস্থান করে। উষ্ণতার
হঠাৎ বৃদ্ধি ঘটে এবং বায়ু প্রবাহের দিক ক্রমশ পূর্ব থেকে দক্ষিন পূর্ব দিকে পরিবর্তন
হয় । আকাশ
নিম্বোস্ট্রাটাস মেঘের ঘন কালো আবরনে ঢেকে যায় এবং বৃষ্টিপাতের সূচনা হয়। উষ্ণ
বায়ু ক্রমশ শীতল বায়ুর উপরে উঠতে থাকলে বৃষ্টিপাতের পরিমান বাড়তে থাকে এবং বৃষ্টিপাতে
কুয়াশাময় বাতাসের উপস্থিতির জন্য দৃশ্যমানতা খুব কম হয়। সবশেষে
বর্জ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হয়, যা নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতের অন্তিম পর্যায় কে
সূচিত করে এবং এই সময় প্রতীপ ঘূর্নবাতের আগমন ঘটে।
নাতিশীতোষ্ণ
ঘুর্নবাত সৃষ্টি সম্বন্ধীয় জে. বার্কনেসের মেরু সীমান্ত তত্ত্ব
ভি.
বার্কনেস ও জে. বার্কনেস ১৯১৮ সালে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাত সৃষ্টি
সম্পর্কীত মেরু সীমান্ত তত্ত্বের উপস্থাপনা করেন। ঘূর্নাবতের সৃষ্টি থেকে
শুরু করে বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত সময়কাল কে ঘূর্নবাতের জীবনচক্র বলা হয়। তারা
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্নবাতের জীবনচক্রকে ৬ টি পর্যায়ে ভাগ করে ব্যাখ্যা করেন
প্রথম
পর্যায় – প্রথম পর্যায়ে দুটি ভিন্ন ভৌত ধর্ম বিশিষ্ট বায়ু পুঞ্জ অর্থাৎ মেরু থেকে
শীতল মেরু বায়ু এবং নিরক্ষীয় উষ্ণ পশ্চিমা বায়ু পরস্পরের সমান্তরালে বিপরীত দিকে
প্রবাহিত হয়। এই পর্যায়ে শীতল ও উষ্ণ বায়ু যে সীমান্ত বরাবর মিলিত হয়, তাকে সাম্য
সীমান্ত বলে। এই সময় শান্ত আবহাওয়া থাকে।
দ্বিতীয়
পর্যায় – এই পর্যায়ে শীতল বায়ু তরঙ্গের আকারে স্ফীত হয়ে উষ্ণ বায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে। ফলে সাম্য সীমান্তে তরঙ্গের ন্যায় ভাঁজের সৃষ্টি হলে দুটি সীমান্তের উদ্ভব হয়। যে সীমান্তে শীতল বায়ুপুঞ্জ শক্তি বেশি হয়, তাকে শীতল সীমান্ত বলে এবং যে সীমান্তে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জ শক্তিশালী হয়, তাকে উষ্ণ সীমান্ত বলে। এই পর্যায়ে ঘূর্নবাত সৃষ্টির
সূচনা হয় বলে একে সূচনা পর্ব বলা হয়।
তৃতীয়
পর্যায় – এই পর্যায়ে শীতল বায়ুপুঞ্জ, উষ্ণ বায়ুপুঞ্জকে ঠেলে উপরে উঠিয়ে দেয় বলে ভাঁজের তীক্ষ্ণতা আরো বেড়ে যায়। এই পর্যায়ে ঘূর্নবাত সম্পূর্ন রূপে গড়ে ওঠে বলে, একে পরিণত পর্যায় বলে।
চতুর্থ
পর্যায় – শীতল সীমান্ত উষ্ণ সীমান্তের দিকে আরও অগ্রসর হয় ফলে উষ্ণ সীমান্ত ক্রমশ
সংকুচিত হয়ে আসে এবং উষ্ণ বায়ু মেরু বায়ুর দিকে অবক্ষিপ্ত হয়। এই উষ্ণ বায়ুকে শীতল বায়ু তিন দিক থেকে বেষ্টন করে থাকে। এই পর্যায়ে ঘূর্নবাতের তীব্রতা সর্বাধিক হয়।
পঞ্চম
পর্যায় – এই পর্যায়ে এসে শীতল সীমান্ত উষ্ণ সীমান্ত কে সম্পূর্ন রূপে ঘিরে ফেলে,
একে অক্লুডেড সীমান্ত বলে। এই পর্যায়ে প্রবল ঘূর্নবাতের সৃষ্টি হয়। উষ্ণ বায়ু
উপরে উঠে ঘনীভূত হয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই অবস্থায় উষ্ণ বায়ু শীতল বায়ু দ্বারা সম্পূর্ন রূপে আবদ্ধ হয়ে মূল বায়ুপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাই ঘূর্নবাত ধীরে ধীরে তার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
ষষ্ট
পর্যায় – এই পর্যায়ে অক্লুডেড সীমান্ত ক্রমশ অন্তর্হিত হতে থাকে এবং উষ্ণ ও শীতল
সীমান্তের মধ্যে তেমন উষ্ণতার পার্থক্য আর থাকে না ফলে ঘূর্নবাতের বিলুপ্তি ঘটে।
কোন মন্তব্য নেই: